বিপুলা এই ভারতবর্ষ। কত ভাষাভাষী, জাত, ধর্মের মানুষের বাস। প্রকৃতিও যেন বৈচিত্রের ডালি উপুড় করে দিয়েছে এখানকার গ্রামে শহরে। রুক্ষ মরুভূমি থেকে বরফ ঢাকা পাহাড়, অরণ্য জঙ্গল থেকে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র – সব মিলবে এই দেশেই।
জীবনযাপনের মান তেমন উন্নত নয়। দারিদ্রতা নিত্যসঙ্গী। এরপরও মানুষের সম্মিলিত চেষ্টা ইতিহাস তৈরি করে। এমন উদাহরণ তৈরি করে গোটা দেশ ঘুরে তাকাতে বাধ্য হয়। এখানে আমরা তেমনই ভারতের ১০ গ্রামের তালিকা তৈরি করেছি। যেখানকার বাসিন্দারা সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয় হাসিল করে নিতে পারেন।
১০) মাওলিনং গ্রাম
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামের মর্যাদা পেয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত ছোট্ট গ্রাম মাওলিনং। শিলং থেতে ৯০ কিলোমিটার দূরে। শিলং থেতে ৯০ কিলোমিটার দূরে। পশ্চিম খাসি পার্বত্য জেলার ছোট্ট গ্রাম মাওলিনং-এ মাত্র ৬০০ পরিবারের বাস। ‘ডিসকভারি ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন’-এর মতে এটাই এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম।
১৩০ বছর আগে মাওলিনং গ্রামে কলেরা দেখা দেয়। সেই রোগ ঠেকাতেই শুরু হয় পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সেই শুরু। আজও চলছে। বাঁশের তৈরি ডাস্টবিনে সংগ্রহ করা হয় আবর্জনা। তা থেকে তৈরি হয় জৈব সার। রাস্তা ঘাট ঝাড়ু দেবার জন্য স্বেচ্ছাসেবীরা আছেন। নোংরা ভুলেও কেউ ফেলেন না। প্লাস্টিকের সামগ্রী নিষিদ্ধ।
৯) ধরনী গ্রাম
বিহারের এই প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা ৩০ বছর ধরে অন্ধকারে ছিলেন। নিজেদের চেষ্টায় সারা গ্রাম জুড়ে তৈরি করেছেন সোলার সিস্টেম। গত বছরের জুলাই থেকে বিদ্যুৎ এসেছে গ্রামে। হাসি ফুটেছে গ্রামবাসীর মুখে। শিশুরা রাতেও পড়তে পারে। মেয়েরাও সন্ধ্যার পর রাস্তেঘাটে বেরয়।
৮) পুনসারি গ্রাম
যারা গ্রাম বলতে এখনও কাদা প্যাচপ্যাচে রাস্তা, ঝোপ জঙ্গল, সাপের উপদ্রব বোঝেন, তাঁদের অন্তত একবার এই গ্রামে ঘুরে আসা উচিৎ। পরিকাঠামোর দিক থেকে যে কোনও মেট্রো শহরকেও লজ্জা দেবে গুজরাটের সবরকন্ঠ জেলার পুনসারি গ্রাম।
গ্রামের প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে সিসিটিভি। ২৪ ঘণ্টা ওয়াইফাই পরিষেবা। প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য ১ লক্ষ টাকার দূর্ঘটনা বিমা এবং ২৫ হাজার টাকার মেডিক্লেম। গ্রামের মধ্যে যাতায়াতের জন্য চালু বাস সার্ভিস। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এসি ক্লাসরুম। রয়েছে ১৪০ লাউডস্পিকার, যাতে যে কোনও সময় যে কোনও মানুষ সাহায্য চাইতে পারেন। প্রতি বাড়িতে শৌচাগার। ২ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। গ্রামের রাস্তায় সৌরবিদ্যুতের আলো।
কী করে সম্ভব ভাবছেন? কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের প্রত্যেকটি প্রকল্পের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করেছিলেন পুনসারি গ্রামের বাসিন্দারা। আর কিছু নয়।
৭) হাইওয়ার বাজার
মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের হাইওয়ার বাজার ভারতের সবচেয়ে ধনী গ্রাম। গ্রামবাসীদের অধিকাংশই কোটিপতি। মিলিত সম্পত্তির পরিমাণ ৬০ মিলিয়নের বেশী। তাই এই গ্রামকে ‘সিক্সটি মিলিওনিয়ার্স ভিলেজ’ নামেও ডাকা হয়। বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা দিয়ে চাষবাস ও খরা মোকাবিলায় নজির গড়েছে হাইওয়ার বাজার গ্রাম।
৬) চাপ্পার গ্রাম
এই দেশেরই হরিয়ানার ছাপ্পর গ্রামে মেয়ে জন্মালে পরিবারের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ ধরা হয়। মিষ্টি বিতরণ করা হয় বাড়ি বাড়ি। এখানকার কোনও মহিলাই একহাত ঘোমটা টানেন না, বোরখারও চল নেই। গ্রামের মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ নেই বললেই চলে। এইসব কারণেই বোধহয় দেশের সেরা মহিলা অ্যাথলিটদের বাড়ি হয় হরিয়ানায়। ইস…যদি সব গ্রামই এমন ভাবত!
আরো পড়ুন : ভারতের সেরা ১৩ টি হাসপাতাল – সুখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য

৫) কোকরেবেলুড় গ্রাম
এখনও পাখির ডাকেই ঘুম ভাঙে কর্নাটকের ককরেবেলুড় গ্রামের বাসিন্দাদের। পাখিদের খাওয়ার জন্য আছে খোলা জায়গা। পাখি আর এখানকার মানুষের মধ্যে অদ্ভুত সখ্যতা। এখানে বিপন্ন প্রজাতির বহু পাখি দেখা যায়। আহত পাখিদের সুস্থ করার ব্যবস্থাও আছে কোকরেবেলুড় গ্রামে। নিয়ম করে কড়া পাহারায় থাকেন গ্রামবাসীরা যাতে পর্যটকেরা এসে পাখি মারতে না পারেন।
৪) বালিয়া গ্রাম
জলসঙ্কট বহুদিনের। পানীয় জলের জন্য হ্যান্ডপাম্প দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তারপর থেকেই ত্বকের নানা সমস্যায় ভুগতে থাকেন বাসিন্দারা। বোঝা যায় আর্সেনিক। সরকারের ভরসায় বসে না থেকে কুয়ো থেকে জল তোলার ব্যবস্থা করেন। ভিন্ন উপায়ে আর্সেনিক প্রতিরোধ করে সারা দেশের কাছে মডেল গ্রাম উত্তরপ্রদেশের বালিয়া।
আরো পড়ুন : ভারতের ৮টি মজাদার আইন যেগুলি শুধু হাস্যকর নয় রীতিমতো অর্থহীন
৩) পাতানিক্কড় গ্রাম
অশিক্ষার হার যে দেশে সবচেয়ে বেশী সেখানকারই কেরালার পাতানিক্কড় গ্রামে শিক্ষিতের হার একশো শতাংশ। হ্যাঁ। গ্রামের লোকসংখ্যা ১৭, ৫৬৩। সবাই শিক্ষিত। আরও আশ্চর্যের, এই গ্রামে শহুরে মানের কোনও বিদ্যালয় নেই। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি স্কুল খোলা হয়েছে। শুধু শিক্ষিত থাকার মানসিকতাতেই শিক্ষিত হয়েছেন এখানকার বাচ্চা-বুড়ো!
২) বেক্কানাকেরি
প্রাতঃকৃত্ত সারতে গ্রামের মানুষ সাধারণত খোলা মাঠই বেছে নেন। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে গ্রাম-পরিষদের সদস্যরা ভোর থেকে মাঠে-ময়দানে ‘ওঁত’ পেতে থাকতেন। গ্রামবাসীদের দেখলেই ‘সুপ্রভাত’ বলে সম্বোধন করতেন তাঁরা। ‘গাঁধীগিরি’-র এই ফর্মুলায় বন্ধ হয়েছে মাঠেঘাটে ‘কু’কীর্তি।
আরো পড়ুন : ভারতের সবথেকে নিরাপদ ১০টি শহর
১) শনি সিঙ্গনাপুর
মহারাষ্ট্রের আহমেদ জেলার ১৫৬ বছরের প্রাচীন গ্রাম শনি সিঙ্গনাপুর। এই এলাকার কোনও বাড়িতেই কোনও দরজা নেই। শুধু গৃহস্থ বাড়ি নয়, সরকারি কোনও দপ্তর যেমন থানা, গেস্টহাউজ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন কোথাও কোনও দরজা নেই। পর্দা ঝোলাতে চাইলে সেটা হতে হবে ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ এবং সেটাও অর্ধেক সরিয়ে রাখতে হবে! বিশ্বাস করুন, এরপরও একটা দেশ্লাই কাঠি চুরি হয়নি এই গ্রাম থেকে! না হয়েছে খুন ধর্ষণের মতো কোনও অপরাধ।
আমাদের প্রতিটি পোস্ট WhatsApp-এ পেতে ⇒ এখানে ক্লিক করুন