আজ তার সবচেয়ে বড়ো সাফল্যের দিনেও কিছুটা দুঃখ চোখের কোনে দেখা গেল মেধাবী কৃতী ছাত্রী অনিশার। মাধ্যমিকের পর আজ উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। আর এই ফলাফলে নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছে অনিশা। বীরভূম জেলার এই কৃতী ছাত্রী জেলার মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে এবং জেলার মধ্যে ছাত্র ছাত্রীদের নিরিখে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। সারা রাজ্যে অনিশা ১ থেকে ১০ এর যে মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে অষ্টম স্থান অধিকার করেছে। এবছর সে বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের কোটাসুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছিল।তবে তার এই সাফল্য যে খুব সহজে আসে নি, তা আমরা জানতে পারি তার সাথে কথা বলে।

অনিশা জানায়, “আজ থেকে সাত বছর আগে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমার বাবাকে হারিয়েছিলাম। আর তারপরই আমার পড়াশোনা ও পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। আর সেই সময় শক্ত হাতে আমাদের পরিবারকে ধরে দাদু, কাকা, ঠাকুমা। সেই অল্প বয়সে আমাকে তারা ভালোবাসা, আদর, এবং স্নেহ দিয়ে বড়ো করে তোলে। একবারের জন্যে তারা আমাকে বাবাকে মনে পড়তে দেয় নি। বাবার মতো করেই যখন যা চেয়েছি ,তখন তাই দিয়েছে। তারাই আমার পড়াশোনায় আমাকে গাইড করেছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি খুব ভালো সাফল্য না পেলেও, আমার প্রাপ্ত নাম্বার ছিল ৯০.৪%। আর তাই তখনই ঠিক করেছিলাম সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে পড়লে আমারও সাফল্য আসতে পারে।
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের স্বপ্ন নিয়ে ওষুধের দোকানের কর্মচারীর ছেলে মেধা তালিকায় পঞ্চম
তাই সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছি। তাই মাধ্যমিকের পর কলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। আর আমার এই লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষিকা সবার থেকেই আমি সাহায্য পেয়েছি দারুন ভাবে।ওদের সকলের মিলিত চেষ্টার ফলেই আজ আমার এই সাফল্য। আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায়, আসেনি সকল বিষয়ে আলাদা করে টিউশন নিতে পারি নি। তবুও কাকা, ঠাকুরদা সবাই দুটি টিউশন দিয়েছিল। আর সেই টিউশন বা কোচিং সেন্টারের স্যারদের থেকেও আমি সাহায্য পেয়েছি অনেক। আর তাই এই সাফল্য।”
আরও পড়ুন : সবজি বিক্রেতার ছেলে আর্থিক প্রতিকূলতাকে জয় করে মেধাতালিকায় ছিনিয়ে নিল অষ্টম স্থান
অনিশার প্রাপ্ত নাম্বার ৪৮৩। তাকে তার এই সাফল্যের পেছনে পরিশ্রমের কথা জানতে চাইলে সে বলে, “নিয়ম করে সকাল ,সন্ধ্যা পড়তে বসেছি। আর তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পরামর্শ মেনে চলেছি।তারা আমাকে পড়ার থেকে লেখার বিষয়ে জোর বেশি দিতে বলেছিল, আর তাই অনুসরণ করেছি।বারবার পাঠ্য বই পড়েছি এবং টেস্ট পেপার থেকে অনুশীলন করেছি। টিউশন, ও বিদ্যালয় ছাড়া সারাদিন বাড়িতে ৫-৬ ঘন্টা পড়তাম।তবে টেস্টের পর বিদ্যালয় ছুটি থাকার সময় এই নিজের অধ্যয়নের সময়টা বেড়েছিল।আমার পরিবার আমাকে সবসময় উৎসাহ জুগিয়েছে ভালো কিছু করার। তারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।আমার দাদুর, কাকার, মায়ের এক কথায় বলতে গেলে সবার ভূমিকা আছে আমার এই সাফল্যে।কিন্তু আজ যদি বাবা আমাদের মাঝে থাকতেন ,তাহলে তিনি আমার এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।বাবা হারানো এইরকম মেধাবী মেয়ের সাফল্যে তার গ্রামের, জেলার এমনকি রাজ্যের সকল মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে।
আরও পড়ুন : টালির ভাঙা ঘর থেকে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নে গামছা বিক্রেতার ছেলে অমিয়
তার মা মিতালি মন্ডল মেয়ের এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। তবে চোখের জলের কারণ জানতে চাইলে তার স্বামীর উপস্থিতির অভাবকে বড়োই অনুভূত করছেন বলেই জানান।তবুও মেয়ের এই সাফল্য তার স্বর্গীয় বাবার আত্মাকে অনেক বেশি শান্তি দেবে বলেই তার ধারণা। অনিশার কাকা অমরেন্দ্র বাবু জানান তার ভাইঝি অনিশা ছোট থেকে অনেক কষ্টের সাথে মানুষ হয়েছে।আর এই কষ্ট তাকে করে দিয়েছিল ভালো কিছু করার জেদ। আর এই জেদই তার এই সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি বলেই তিনি মনে করেন।