
১৪ জুন বলিউডের তরুণ অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের বান্দ্রার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় তার ঝুলন্ত দেহ। দিল্লি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবেশিকা পরীক্ষায় সপ্তম স্থান পেয়েছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াডে জয়ী হয়েছিলেন। হতেই পারতেন মেধাবী, উচ্চপদস্থ চাকুরে। কিন্তু তার পরিবর্তে সুশান্ত সিংহ রাজপুত বেছে নিয়েছিলেন রুপোলি দুনিয়াকেই।
মাত্র ৩৪ বসন্ত কাটিয়েই থেমে গেলেন সুশান্ত। ইদানীং তাঁর ছবি প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছিল না বক্স অফিসে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নিজেই নিজেকে দিলেন না। ইতি টানলেন জয়যাত্রায়। প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে, সত্যিই কি আত্মহত্যা? নাকি পরিকল্পিত খুন?
সুশান্তের মৃত্যুর পর থেকেই জানা যায় অবসাদে ভুগছিলেন অভিনেতা এবং সেই কারণেই একজন মনোবিদের পরামর্শও নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশের ডেপুটি কমিশনার অভিষেক ত্রিমুখ জানিয়েছেন কোনও ওষুধ খাচ্ছিলেন না তিনি। মি. ত্রিমুখ আরও জানান যে সুশান্তের বোন, দুজন ম্যানেজার, পরিচরিকা, অভিনেতা মহেশ শেঠি এবং যে চাবি প্রস্তুতকারীকে সুশান্তের শোয়ার ঘরের দরজা খুলতে ডাকা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের স্টেটমেন্ট রেকর্ড করেছে পুলিশ।
পোস্ট মর্টার্ম রিপোর্টে দেখা গেছে সুশান্তের মৃত্যুর কারণ অ্যাসফিক্সিয়া যা গলায় ফাঁস লাগানোর জন্য হয়েছিল। একজন পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন সুশান্ত অভিনেতা মহেশ শেঠি কে কল করেছিলেন কিন্তু যেহেতু তিনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন তাই তিনি সেই ফোন ধরতে পারেননি, পরে যখন তিনি ঘুরিয়ে কল করেন তখন ফোন তোলেননি সুশান্ত। সম্ভবত ততক্ষণে চরম পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছিলেন সুশান্ত।
মুম্বাই পুলিশের এক আধিকারিক সুশান্ত সিং রাজপুতের বাবা কে কে সিং কে প্রশ্নোত্তর করে জানতে পারেন যে সুশান্তের অবসাদগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি জানতেন না তার পরিবারের কেউই। তিনি আরও জানান যে তার বাবা কারুর ওপর কোনো সন্দেহের কথা বলেননি। সুশান্তের ম্যানেজার সিদ্ধার্থ পিঠানি মুম্বাই পুলিশকে বলেন যে সুশান্ত তার অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ওষুধ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।এক আধিকারিক বলেন যে পিঠানি সুশান্তের বাড়িতেই থাকতেন। অবসাদের কারন তিনি জানেন না তবে তিনি সুশান্তের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় বেশ অনেক সপ্তাহ ধরেই আর ওষুধ খাচ্ছিলেন না তিনি।
While the post mortem report says actor @itsSSR committed suicide by hanging himself, there are media reports that he allegedly suffered from clinical depression because of professional rivalry. @MumbaiPolice will probe this angle too.
— ANIL DESHMUKH (@AnilDeshmukhNCP) June 15, 2020
মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অনিল দেশমুখ সোমবার টুইট করে জানান যে পোস্ট মরটার্ম রিপোর্টে যেখানে বলা হচ্ছে যে তার মৃত্যু গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার জন্য হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন মাধ্যম তুলে ধরছে যে কর্মক্ষেত্রে শত্রুতার কারণে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।মুম্বাই পুলিশ এই দিকটিকেও তদন্ত করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বুধবার বলিউডের পরিচালক এবং সুশান্তের নিকট বন্ধু মুকেশ ছাবড়া কে প্রশ্নোত্তর করে মুম্বাই পুলিশ। মুম্বাই পুলিশ জানায় যে ছাবড়া জানিয়েছেন সুশান্ত ফোনে কথা বলতে সহজ বোধ করতেন না এবং তিনি সবসময় ফোন কলের উত্তরও দিতেন না।
মুম্বই পুলিশ ডাক পাঠাতে চলেছে ওই প্রযোজনা সংস্থাকে। খতিয়ে দেখা হবে সুশান্তের সঙ্গে তাদের চুক্তিপত্র। মুম্বাই পুলিশ বৃহস্পতিবার ইয়াশ রাজ ফিল্মস কে সুশান্ত সিং এর সাথে তাদের কনট্র্যাক্ট এর একটি কপি দেখাতে বলে। অনিল দেশমুখ তার একটি ট্যুইটে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে মুম্বাই পুলিশ যেন তার কর্মক্ষেত্রের শত্রুতার দিকটি খতিয়ে দেখে কারন তার অবসাদের পেছনে এটিও একটি কারণ হতে পারে।এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো সুশান্ত গত দুই বছরে ইয়াশ রাজ ফিল্মসের হয়ে কাজ করছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে সুশান্ত জানিয়েছিলেন, কেরিয়ারের শুরুতে তিনি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন যশরাজ ফিল্মের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী তাঁর ৩টি ছবি করার কথা ছিল এই ব্যানারের সঙ্গে। তার মধ্যে দু’টি ছবি ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ এবং ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ বাস্তবায়িত হলেও তৃতীয় ছবি ‘পানি’ ছবিটি হয়নি। অথচ এই ছবির জন্য ১১ মাস অভিনেতাকে অন্য ছবিতে সই করতে দেননি আদিত্য চোপড়া! পরিচালক শেখর কপূরের সম্প্রতি টুইটে সে কথা স্বীকার করে জানান, এর পরেই প্রথম ভেঙে পড়েন সুশান্ত।
আবার এই চুক্তির কারণেই দুটো বড় ছবি হাতছাড়া হয়েছিল সুশান্তের। যার মধ্যে একটি সঞ্জয় লীলা ভনশালীর ‘রাম লীলা’, অন্যটি ‘বেফিকরে’। ছয় মাসের মধ্যে সাতটি ছবি হাতছাড়া হয়ে গেছিল সুশান্তর। অথচ চুক্তিতে থাকা সত্ত্বেও রণবীর সিংহ একাধিক অন্য ছবিতে অভিনয়ের অনুমতি পেয়েছিলেন। তার জ্বলন্ত উদাহরণ ‘রাম লীলা’।
এদিকে যশরাজ ফিল্মসকে সমন পাঠানোর আগেই সুশান্তের মৃত্যুর জন্য নেপোটিজম বা পক্ষপাতিত্বকে দায়ী করে বুধবার বিহারের মজফফরপুর জেলা আদালতে বলিউডের চার তারকা সলমন খান, কর্ণ জোহর, একতা কপূর, সঞ্জয় লীলা ভনশালীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী সুধীর কুমার ওঝা।
তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালীন অভিনেতা সুশান্তের চিকিৎসক তথা মনোবিদ কেশড়ি চাভড়ার সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে নতুন তথ্য। জানা গেছে অঙ্কিতা লোখন্ডের সঙ্গে সম্পর্কের ভাঙন মেনে নিতে পারেননি সুশান্ত সিং রাজপুত। মৃত্যুর আগে গত ৬ মাসে ৩বার মনোবিদ কেশরি চাভড়ার চেম্বারেও গিয়েছিলেন তিনি। সুশান্তের চিকিৎসক আরও জানিয়েছেন, গত একবছর ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না তিনি।
অঙ্কিতার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পরে অনেক নায়িকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুশান্ত। কিন্তু কেউই অঙ্কিতার মনের মতো ছিলো না। এমনকী, রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গেও তাঁর সেভাবে মিল নেই। রিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যবহার, কথাবার্তা, ঝগড়াঝাটি নিয়েও চিকিৎসকের কাছে একাধিকবার মুখ খোলেন সুশান্ত সিং রাজপুত। শুধু তাই নয়, রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে তিনি যে মোটেও খুশি নন চিকিৎসককে সেকথাও জানিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
পুলিশ অভিনেতার পি আর ম্যানেজার রাধিকা নিহালানি এবং প্রাক্তন ব্যবসায়িক ম্যানেজার শ্রুতি মোদীর স্টেটমেন্ট রেকর্ড করেছে। ম্যানেজারের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে যে সুশান্ত “নেশন ইন্ডিয়া ফর ওয়ার্ল্ড” নামে একটি চ্যারিটি বা জনসেবামূলক কোম্পানি তৈরি করেছিলেন।অন্যদিকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কন্টেন্ট তৈরির জন্য তিনি “ভিভিড রেজ রিয়ালিস্টিক” নামে একটি কোম্পানির সাথে যুক্ত ছিলেন।
পুলিশ আধিকারিক বলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও বিভিন্ন প্রকার কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত।অন্যদিকে বৃহস্পতিবার পুলিশ যখন রিয়া চক্রবর্তীকে প্রায় ঘন্টা আটেক প্রশ্নোত্তরের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন তিনি জানান যে সুশান্ত কোনো একটি প্রোডাকশন হাউসের সাথে তার চুক্তি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাদের সাথে সুশান্তের ২০১২ সালে তিনটি ছবির কনট্র্যাক্ট থাকায় সুযোগ পেয়েও অন্য ভালো কাজ করতে পারেননি তিনি। পুলিশ বলেছেন এই সব অভিযোগ খতিয়ে দেখবে পুলিশ। সব মিলিয়ে বলা চলে সুশান্তের মৃত্যু টানটান রহস্যপূর্ণ। আসল সত্যের অপেক্ষায় সকলে।