রথযাত্রা উড়িষ্যার প্রধান উৎসব হলেও বর্তমানে সারা ভারতের হিন্দুদের মধ্যে সমান ভাবেই জনপ্রিয় রথযাত্রা। আজকের আলোচনা রথের সেইসব পুরানো দিন নিয়ে নয়, অতীতের অনেকটা দূরে আমরা গিয়ে জানতে চেষ্টা করবো রথ যাত্রা সৃষ্টির ইতিহাস। রথযাত্রা বহুল প্রচলিত উত্সরব হলেও কিছু তথ্য আজও অজানা। তাই আজ আমরা প্ৰথমে জানবো এইসব ভগবান বিশেষ করে জগন্নাথ ভগবানের এই ধরাধামে আবির্ভাব নিয়ে।
পৌরানিক মত অনুযায়ী, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ তার পরম ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুর ভক্তিতে তার সামনে আবির্ভাব হয়ে তাকে বলেন সমুদ্রে ভেসে আসা একটি কাঠের খন্ড দিয়ে তার প্রতিমূর্তি তৈরি করে তা পূজা করতে। রাজা তখন মূর্তি নির্মাণের জন্য ভালো কাঠের মিস্ত্রি সন্ধান করেন।
সেই সময় দেবশিল্পী দেবতা বিশ্বকর্মা এক বৃদ্ধ কাঠের শিল্পী হিসেবে সেই খানে হাজির হন এবং রাজার কাছে ওই কাঠের মূর্তি তৈরি করার জন্য কিছুদিন সময় চেয়ে নেন। তবে তিনি একটা শর্ত দেন, তিনি যখন বন্ধ ঘরের মধ্যে মূর্তি তৈরি করবেন তখন তা যেন কেউ দেখতে না আসে। রাজা তার শর্তে রাজি হয়ে তাকে মূর্তি তৈরি করতে আদেশ জানান।
কিন্তু দিন যত যেতে থাকে তত রাজা ও রানীর মধ্যে মূর্তি তৈরির ব্যাপারে উৎসাহ বাড়তে থাকে। তারা কাঠে খোদাইয়ের কাজের আওয়াজ শুনতে পেলেও ভিতরে গিয়ে চাক্ষুস দেখার লোভ সামলে রাখেন। এইভাবে তারা ৬-৭দিন ওই বন্ধ ঘরের দুয়ারে এসে কাজের উন্নতির অবস্থা কান দিয়ে শুনতে থাকেন।
এইভাবে হঠাৎ একদিন তারা কোন কাঠের খোদাইয়ের আওয়াজ না শুনতে পেয়ে কৌতূহলী রানী আর থাকতে না পেরে দরজা খুলে মূর্তি নির্মাণ কক্ষে প্রবেশ করে ফেলেন।দেখেন মূর্তি তখন অর্ধেক তৈরি হয়েছে আর যে শিল্পী এই কাজ করছিল তিনি অদৃশ্য হয়েছেন।তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।মূর্তির এরকম অবস্থা দেখে রাজা খুব দুঃখিত হয়ে পড়েন।এইসময় দেবর্ষি নারদ রাজার কাছে এসে এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিকেই ভগবান কৃষ্ণের মূর্তি রূপে পূজা করতে উপদেশ দেন।আর এইভাবেই ভগবান জগন্নাথ দেবের এই রূপ বিদ্যমান।
জগন্নাথের রথের বিশেষত্ব
জগন্নাথের রথের উচ্চতা প্রায় ৪৫ফুট। এই রথের বিশেষ নামও আছে, আর তা হল নন্দীঘোষ। এছাড়াও একে কপিধ্বজও বলা হয়ে থাকে কারণ এই রথের উপর থাকা পতাকায় হনুমানের মূর্তি আঁকা আছে।এই রথে চাকার সংখ্যা ১৬টি। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুটের সমান। রথটি নীচের দিকেহলুদ রঙের পর্দা এবং উপরের দিকে লাল রঙের পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকে। এই রথে থাকে চারটি সাদা রংয়ের ঘোড়া। এদের নাম যথাক্রমে শঙ্খ, বহ্লক, শ্বেত এবংহরিদাশ্ব। এই রথের সারথির নাম দারুক । এই রথ টানা দড়ির নাম শঙ্খচূড়।
বলরামের রথের বিশেষত্ব
এই রথের উচ্চতা প্রায় ৪৪ফুট। এই রথের নাম তালধবজ। এই রথ নীল আভরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। এই রথে চাকার সংখ্যা ১৪টি। বলরামের রথের চারটি ঘোড়ার রংহয় কালো, এদের নাম হল যথাক্রমে তীব্র, ঘোড়া, দীর্ঘশর্মা এবং স্বর্ণনভা। সারথির নাম মাতলি। যে দড়িটি ধরে রথটি টানা হয় তার নাম হল বাসুকি।
সুভদ্রার রথের বিশেষত্ব
এই রথের উচ্চতাপ্রায় ৪৩ফুট। এই রথের নাম দেবদলনা বা পদ্মধ্বজ ও বলা হয়ে থাকে, কারণ রথটির পতাকায় পদ্ম চিহ্ন আছে। এই রথ লাল রঙের আভরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। এই রথে থাকে চারটি লাল ঘোড়া। ঘোড়াগুলির নাম রচিকা, মচিকা, জিতা এবং অপরাজিতা। সারথির নাম অর্জুন। এই রথ টানা দড়ির নাম স্বর্ণচূড়া ।
মূর্তি নির্মাণ
জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রা মূর্তি নিম কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়। প্রত্যেক ১২ বছর পর একটি গোপন রীতি মেনে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে নতুন শরীর দেওয়া হয়। অর্থাৎ নতুন রূপে তৈরি করা হয় যাকে বলা হয় পুনর্জন্ম বা নবকলেবর। এই নিম কাঠ যেমন তেমন নিমকাঠ নয়। এমন নিম গাছ বেছে নিতে হয় যে গাছে পাখি বাসা করে না, পশুরা বাস করে না। যে নিম গাছ সাপ ঘিরে রাখে। যে নিম গাছ সোজা হবে। এই নিম গাছ থেকে চন্দনের সুগন্ধ বের হবে। গাছে শঙ্খ ,চক্র ,গদা ও পদ্মের চিহ্ন থাকবে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এই গাছের স্বপ্নাদেশ পাবেন।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বিশেষ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য
পুরীর জগন্নাথ মন্দির ১০৭৮ সালে তৈরি হয়। ১১৭৪ সালে তা মেরামতির পর আজকের জগন্নাথ মন্দিরর রূপ ধারণ করে। এই পুরী জগন্নাথ মন্দিরের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট আছে। যা কিনা অবিশ্বাস্য৷
এই মন্দিরের সবচেয়ে বড় প্রাসাদটির ছায়া দিনের কোনও সময়ই পড়ে না।
পুরীর যে কোনও জায়গা থেকে মন্দিরের দিকে তাকালে মন্দিরের চুড়ার মধ্যে থাকা সুদর্শন চক্রসবসময় আপনার সম্মুখীন থাকবে।
এই মন্দিরের চূড়ায় যে পতাকাটি লাগানো রয়েছে তা সবসময় হাওয়ার বিপরীত দিকে ওড়ে। যা আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে।
এই মন্দিরের উপর দিয়ে কোনও পাখি বা বিমান উড়তে পারে না বা উড়ে যায় না।
এই মন্দিরের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বৈশিষ্ট হল এর মহাপ্রসাদ। সারা বছর ধরেই সমপরিমান প্রসাদ রান্না করা হয়। কিন্তু ওই একই পরিমান প্রসাদ দিয়ে
কয়েক হাজার মানুষ হোক বা লক্ষ মানুষকে খাওয়ানো হোক তবু প্রসাদ কখনও নষ্ট হয় না বা কখনও কম পরে না।
সাধারণত দিনের বেলায় হাওয়া সমুদ্রের দিক থেকে তীরের দিকে আসে। আর সন্ধ্যের সময় তীরের দিক থেকে সমুদ্রের দিকে হাওয়া চলে। কিন্তু পুরীর ক্ষেত্রে তা ঠিক উল্টো। সকাল তীরের দিক থেকে সমুদ্রের দিকে হাওয়া চলে, এবং সন্ধ্যায় সমুদ্রের দিকে থেকে তীরের দিকে হাওয়া বয়ে চলে।
মন্দিরের রান্নাঘরে এক বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। একটি পাত্রের উপর আর একটি পাত্র এমন করে মোট ৭টি পাত্র কাঠের জ্বালানির আগুনে বসানো হয় রান্নার জন্য। এই পদ্ধতিতে যে পাত্রটি সবচেয়ে উপরে বসানো থাকে তার রান্না সবার আগে হয়। তার নিচের তারপরে। এভাবে করতে করতে সবচেয়ে দেরিতে সবচেয়ে নিচের পাত্রের রান্না হয়।
মন্দিরের ভিতরে সিংহদ্বারের মন্দিরে প্রবেশ করার পর প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের আওয়াজ আর শুনতে পাবেন না। কিন্তু ওই সিঁড়িটি টপকে গেলে আবার সমুদ্রের শব্দ শুনতে পাবেন। সন্ধ্যাবেলায় এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়।