২০১৯ এর নভেম্বর ডিসেম্বর থেকেই করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানা গেলেও ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ এর মহামারিকে সামাল দিতে নাজেহাল পুরো পৃথিবী। বহু লোকে প্রাণ হারিয়েছেন এই রোগে। অধিকাংশ মানুষের জন্যই এই রোগটি খুব ভয়াবহ নয়, কিন্তু অনেকেই মারা যায় এই রোগে। ভাইরাসটি কীভাবে দেহে আক্রমণ করে, কেন করে, কেনই বা কিছু মানুষ এই রোগে মারা যায়?
করোনা ভাইরাসের প্রথম স্টেজ
এই পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে ভাইরাসটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। আপনার শরীরের কোষগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে এবং সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে এই ভাইরাস। করোনা ভাইরাস আপনার প্রশ্বাসের মাধ্যমে বা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো জায়গায় হাত দেয়ার পর নিজের মুখে হাত দিলে দেহে প্রবেশ করতে পারে। শুরুতে এটি আপনার গলা, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসের কোষগুলোতে আঘাত করে এবং সেই জায়গা গুলোতে করোনা বিস্তার করতে শুরু করে। এরপর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আরো কোষকে আক্রান্ত করতে থাকে।
এই সময়ে আপনি অসুস্থও হবেন না এমনকি হয়ত কিছু মানুষের মধ্যে উপসর্গও দেখা যাবে না। গড় হিসেব করলে এই প্রক্রিয়াটি মানুষের শরীরে ৪-৫ দিন ধরে চলতে থাকে।
এটা কি কোনও সাধারণ অসুখ?
বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতায় করোনা ভাইরাস সংক্রমিত এই রোগটিকে সাধারণ একটি অসুখ বলেই মনে হয়। দশ জনের মধ্যে প্রায় আটজন মানুষের কাছেই কোভিড-১৯ একটি সাধারণ ভাইরাস সংক্রমণ, যার প্রধান উপসর্গ জ্বর ও কাশি। শরীর হালকা ব্যাথা, গলা ব্যাথা এবং পাশাপাশি মাথাব্যাথাও হতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কড়া হলে ভাইরাসের সংক্রমণ হয় সেখানেই সমাপ্ত, আর সেই প্রতিক্রিয়ার জানান দেওয়ার জন্যই গায়ে আসে জ্বর। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করে বাকি শরীরে সাইটোকাইনস নামক রাসায়ানিক পদার্থ পাঠিয়ে বোঝাতে সাহায্য করে যে শরীরে কিছু একটা গলত আছে। এই কারণেই শরীরে ব্যাথা ও জ্বরের মত উপসর্গ দেখা দেয়।
সাধারণত কিরকম লক্ষণ দেখা যায়?
সাধারণত করোনাভাইরাসের কারণে শুষ্ক কাশি দেখা যায়। কোষগুলো ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার কারণেই সম্ভবত শুকনো কাশি হয়ে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কাশির সাথে সাথে থুতু বা কফ বের হওয়া শুরু হবে যার মধ্যে থাকবে ফুসফুসের ভাইরাসের প্রভাবে মৃত কোষগুলোও। নতুন গবেষণায় ধারণা পাওয়া গেছে যে রোগটির এই ধাপে আক্রান্তদের সর্দিও লাগতে পারে।
এইরকম অবস্থায় কি করা উচিত?
এইরকম লক্ষণ দেখা দিলে সম্পূর্ণ বিশ্রাম, গরম তরল পান এবং প্যারাসিটামল খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে সাধারণত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হয় না। এই ধাপটি প্রায় ৭ দিনের মত স্থায়ী হয়। তবে অধিকাংশ আক্রান্তই এই পর্যায়ে সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। কারণ এই কদিনে তাদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ভাইরাসের সাথে লড়াই করে সেটিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। তবে খুব কম এমন ঘটনা রয়েছে যেখানে মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ এর আরো ক্ষতিকর একটি সংষ্করণ তৈরি হয়।
জ্বর যদি না থামে?
এই পর্যায়ে যদি রোগ অব্যাহত থাকে, তবে তা ভাইরাসটির প্রতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার জন্যই। যেই কেমিক্যালগুলো শরীরে বার্তা পাঠায়, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তখন সেগুলোর প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে। এই ক্ষেত্রে সাধারণত ফুসফুসে প্রদাহ তৈরি হয়, যেটাকে নিউমোনিয়া বলে। আপনার মুখ দিয়ে ঢুকে শ্বাসনালী দিয়ে ফুসফুসের ছোট নালীগুলোয় যদি যাওয়া যেত, তাহলে আপনি হয়তো শেষপর্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের বায়ুথলিতে গিয়ে পৌঁছাতেন।
আরও পড়ুন :- জ্বর সর্দি গলাব্যাথা নয়, করোনা সংক্রমনে দেখা যাচ্ছে ৫টি নতুন লক্ষণ
এই থলিগুলো থেকেই রক্তে অক্সিজেন যায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়। কিন্তু নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্র থলিগুলো জলে ভর্তি হতে শুরু করে, ফলস্বরুপ শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিছু মানুষের ভেন্টিলেটরেরও প্রয়োজন হয় শ্বাস নেওয়ার জন্য। চীন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ধাপে মোট আক্রান্তের ১৪% মানুষ পৌঁছোয়।
করোনা ভাইরাসের অন্তিম স্টেজ
এখনও পর্যন্ত ধরা হচ্ছে যে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় ৬% রুগী অতি জটিল পর্যায়ে যায়। এই ধাপে শরীর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে অসক্ষম হতে থাকে এবং মৃত্যুর বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করে। মূল সমস্যাটা হলো, এই ধাপে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে এবং সারা শরীরেই বিভিন্ন রকম ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে।
এই সময় কি কি সমস্যা হয়?
ব্লাড প্রেসার মারাত্মক ভাবে নেমে যায়। তখন এই ধাপে সেপটিক শক পেতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি। এমনকি তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করাও বন্ধ করে দিতে পারে সেই সময়। ফুসফুসে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়লে নিশ্বাস-প্রশ্বাসে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি হয়, কারণ সেসময় শরীরকে ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এর ফলে কিডনি ছেড়ে দিতে পারে রক্ত পরিশোধন করা এবং অন্ত্রের দেয়ালও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এই ক্ষেত্রে।
এই পরিস্থিতিতে কীভাবে চিকিত্সা হয়?
এ পর্যায়ে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম যদি ভাইরাসের সাথে পেরে না ওঠে, তাহলে তা শরীরের প্রত্যেকটি ভাগে ছড়িয়ে পড়ে এবং আরো বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি কে চিকিৎসা দিতে ECMO বা এক্সট্রা-কোর্পোরেয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে।
আরও পড়ুন :- সর্দি জ্বর আর করোনা জ্বরের পার্থক্য, করোনা জ্বর হয়েছে বুঝবেন কীভাবে
এই পদ্ধতিতে একটি কৃত্রিম ফুসফুস দ্বারা নালীর মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করে নিয়ে সেই রক্ত অক্সিজেনপূর্ণ করে আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয়। তবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে কখনো কখনো এই পদ্ধতি আপন করেও কোনো লাভ হয় না। শরীরকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
করোনা আক্রান্ত হলেই কি মৃত্যু নিশ্চিত?
গবেষকরা মনে করছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৫ থেকে ৪০ জন রোগী মারা যেতে পারেন। তবে ইদানীং সেই ধারণা কিছুটা পালটেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে মাত্র ৯ জনের মৃৃত্যু নিশ্চিত হয় এই ভাইরাসের কবলে। অর্থাৎ মৃত্যুহার মাত্র এক শতাংশের কাছাকাছি। যদিও মৃত্যুর বিষয়টি নির্ভর করে বয়স, লিঙ্গ, স্বাস্থ্যগত অবস্থার উপর।
আরও পড়ুন :- পশ্চিমবঙ্গে করোনার হটস্পট এবং নন হটস্পট জেলার তালিকা
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্ক, অসুস্থ আর পুরুষদের মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। এক্ষেত্রেও চিনের পরিসংখ্যান ঘেঁটেই জানা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসে সংক্রমণের শিকার ৪৪ হাজার মানুষের মধ্যে মধ্য বয়সীদের তুলনায় বৃদ্ধদের মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ১০ গুণ বেশি। আর ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা শ্বাসকষ্ট রয়েছে তাদের মধ্যে মৃত্যুহার ৫ গুণ বেশি।