ক্যানসারও থামাতে পারেনি তাঁকে, অদম্য মনোবল নিয়ে চুটিয়ে অভিনয় করছেন চন্দন সেন

লড়াইটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে। তাও আবার মারণ রোগ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। ক্যান্সার, শব্দটি শুনলেই যেন আঁতকে ওঠে বুক! এই রোগের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। রয়েছে কেমোথেরাপির ব্যবস্থা। কেমোথেরাপি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র হলেও তার রেশ যেন ক্যান্সারের প্রভাবের থেকেও বেশি দুঃসহ। তবে তিনি সকল কষ্ট ভিতরে ভিতরে একা সহ্য করে গিয়েছেন। মুখে ফুটে উঠেছে যুদ্ধজয়ের হাসি!

তিনিই অভিনেতা চন্দন সেন। অভিনেতা ব্যাখ্যাটি যথার্থ অর্থেই যেন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দীর্ঘ প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শরীরে ক্যান্সারের যন্ত্রনা চেপে রেখে ছোট পর্দা, বড় পর্দা, বিশেষত থিয়েটারে দাপিয়ে কাজ করে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার থেকে বড় অভিনেতা আর কেই বা হতে পারেন?

সময়টা ২০১০, সেই সময়েই অভিনেতা প্রথম জানতে পারলেন তিনি ফলিকিউলার লিম্ফোমা রোগে আক্রান্ত। তার ঘাড়ের সি-বোনটি ক্যান্সারের প্রভাবে সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গিয়েছে! এখন আর অপারেশন ছাড়া গতি নেই। আর অপারেশন হলে তার ভয়েস বক্সটি বাদ যাবে! গলার স্বর হারাবেন অভিনেতা। আর কোনদিনও অভিনয় জগতে ফিরে আসতে পারবেন না তিনি। একজন শিল্পীর কাছে এর থেকে বড় আঘাত আর কি হতে পারে?

Chandan Sen

সেই সময় চিকিৎসককে প্রশ্ন করা হলে তিনি চন্দনের বেঁচে থাকার মেয়াদ হিসেবে বেঁধে দেন মাত্র ১০ টি বছর। লড়াইয়ের সেই শুরু। দিনের পর দিন চলতে থাকে কেমোথেরাপি। চিকিৎসার ব্যয় বহুল খরচ তার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিল না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তার বন্ধুরা এবং ইন্ডাস্ট্রির চেনা পরিচিতজনেরা। সকলের প্রিয় চন্দন সেনকে এই লড়াইয়ে একা ছাড়েননি কেউ।

পাশে পেয়েছিলেন জীবনসঙ্গিনী ঋতুপর্ণা ঘোষকেও। জানলে হয়তো অবাক হবেন, চন্দন সেন ক্যান্সার আক্রান্ত, এই খবর জানার পরেও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণা। তিনি জীবনসঙ্গিনী হয়েই চন্দনের পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। সকলকে পাশে পেয়ে, অভিনয়ের প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছে শক্তিই তাকে দীর্ঘ ১১ বছর পরেও লড়াইয়ের ময়দানে টিকিয়ে রেখেছে।

Chandan Sen

এছাড়াও এনআরএস মেডিকেল কলেজে যখন তিনি চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলেন, তখন ক্যান্সারাক্রান্ত দরিদ্র মানুষের দুর্বিষহ জীবনও তাকে নিজের লড়াইয়ের জন্য শক্তি জুগিয়েছিল। অভিনেতা দেখেছিলেন, সেই দরিদ্র মানুষগুলির পাশে সেদিন কেউ ছিলেন না। তখন তার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল, কারণ তার পাশে তার বন্ধুরা রয়েছেন, তার পরিবার-পরিজনেরা রয়েছেন।

দিনে ১০ ঘন্টা কেমো নিয়েও যিনি সন্ধ্যার সময় থিয়েটার মঞ্চে এসে অভিনয় করতে পারেন, নাটকের নির্দেশনা দিতে পারেন, তিনিই অভিনেতা চন্দন সেন। জীবনযুদ্ধে তাকে হারাবে, এমন সাধ্যি ক্যান্সারেরও নেই। অভিনেতার কাছে, “It’s kind of training, শরীরকে বেশি পাত্তা দিলেই সাংঘাতিক অবস্থা হবে”! তাই তো তিনি “অক্ষমতা অনিবার্য জেনেও যতদূর সক্ষম থাকা যায়”, সেই লক্ষ নিয়ে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই করে চলেছেন।

অভিনেতা চন্দন সেনের জীবন কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটি বানিয়ে ফেলেন তাদের “কন্ঠ” সিনেমাটি। যেখানে চন্দন সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শিবপ্রসাদ নিজেই। এই ছবিতে উঠে এসেছে জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন ক্যান্সার যোদ্ধার বাস্তব কাহিনী, মনগড়া গাল-গল্প নয়। তার রোগটি এমনই যে, বার বার ক্যান্সার রিল্যাপ্স করবে তার শরীরে। এর কোনো স্থায়ী সমাধান, বা স্থায়ী চিকিৎসা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জানা নেই।

 

তবে অভিনেতাও জীবনযুদ্ধে হার মানতে নারাজ। বিভিন্ন সিরিয়াল এবং ছবিতে অভিনয় করলেও, আদতে তিনি থিয়েটারের জন্যই বাঁচেন যে। থিয়েটার, নাটকে অভিনয়, নাট্য নির্দেশনা, নাট্য রচনাই তাকে বেঁচে থাকার রসদ যোগায় দেয়। তাই তো থিয়েটার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই তিনি ক্যান্সার যোদ্ধা চন্দন সেন থেকে হয়ে ওঠেন অভিনেতা চন্দন সেন। তার এই লড়াই সত্যি অনুপ্রেরণাদায়ক।