সে মহাকাশে যায়। যুদ্ধ বিমান ওড়ায়। জটিল ইকোইয়েশনের সমাধান করে পুরুষের সমান ক্ষিপ্রতায়। সে আবার শিল্পীও। ছবি আকে, অভিনয় করে, গান গায়। এসবের সঙ্গে সংসার সামলায় নিপুন দক্ষতায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করে। মানুষ করে সন্তান।
কোনও কোনও সময়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পুরুষের থেকেও বেশি। সফল পুরুষের পেছনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি একজন নারী। তবুও নারীর জন্য প্রাপ্য সম্মান বরাদ্দ থাকে না কখনও। পুরুষের সমান সম্মান তো নয়ই।
প্রতিকূলতার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন এঁরা। রক্তাক্ত হতে হতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এখানে আমরা বেছে নিয়েছি তেমনই ৪ নারীর জীবন সংগ্রাম।
আরো পড়ুন : একমাত্র মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে “মঙ্গলা মনি”র ৪০৩ দিনের আন্টার্কটিকা অভিযান

মালবিকা আইয়ার
বাড়ির কাছাকাছিই ছিলো অস্ত্রাগার। সেখানে আগুন লাগে। ক্রমশ তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। বহু লোক আতঙ্কে চিৎকার করছে। গ্যারেজে একটি গ্রেনেড এসে পড়ল। বছর তেরর মেয়েটা সেটা তুলে নিতেই বিস্ফোরন। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কীভাবে যেন বেঁচে গেল মালবিকা আইয়ার।
তবে দুহাতের কবজি অবধি উড়ে গেলো। পায়ে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। পায়ের ব্যাথা আজও সেইসব দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেইসব দিন অতীত। অনেকটা এগিয়েছেন, এগতে হবে আরও অনেকটা। এখন তাঁর বয়স ২৮। পিএইচডি শেষ করেছেন। প্রথম মহিলা হিসাবে জিতেছেন ‘ওয়ার্ল্ড ইমার্জিং লিডারস’ খেতাব। গত বছর, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তাঁকে বক্তব্য পেশ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

কৃত্রিম হাত লাগিয়েছেন মালবিকা। দুটো হাতই। লোকজন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। পাত্তা দেন না। ‘যদি কেউ দেখে দেখবে। এই ব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই। তবে একভাবে লাগিয়ে রাখা (কৃত্রিম হাত) ক্লান্তিকর। পরিবার এবং বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে। মানিয়ে নিতে কী অসুবিধার মোকাবিলা করতে হয়েছে? মালবিকার কথায়, ‘বুঝলাম, আমি ভুল ছিলাম না। আমার দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা ভুল ছিল। সেটা বদলে ফেলেছি।’ মালবিকা এমনই। কোনও কিছু অহেতুক জটিল করে দেখেন না। প্রতিদিন অজস্র মেসেজ আসে তাঁর কাছে। কেউ প্রতিবন্ধী, কেউ সাধারণ। সবাই জিততে চায়। মালবিকা তাঁদের প্রেরণা। যিনি বলেন, ‘হাত ছাড়াই আমি স্বনির্ভর।’

অত্রি কর
ছোটবেলা থেকে লড়াই করছেন। লেখাপড়ায় ভালো হলেও স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে টিপ্পনী শুনতে হতো। তবে হাল ছেড়ে দেননি ভারতের হুগলির ত্রিবেণীর ক্যাম্পগেট এলাকার বাসিন্দা অত্রি কর। রূপান্তরকামী বলে গত বছর ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় বসতে মামলা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু আইএএস (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) পরীক্ষায় বসতে পারেননি। কারণ ওই পরীক্ষার তার সরাসরি বসার অধিকার ছিল না। তার ফর্মে কেবল ‘মেল’ আর ‘ফিমেল’ উল্লেখ ছিল। শেষ পর্যন্ত সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে মামলা করে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন। পরীক্ষা দিয়েছেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার প্রার্থী অত্রি কর।
আরো পড়ুন : ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী, যিনি বসতে চলেছেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়

অত্রির দুচোখে আইএএস হওয়ার স্বপ্ন। রিষড়ার বিধানচন্দ্র কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। পার্ট-১ পরীক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেন। চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করেন। গুপ্তিপাড়ার একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পান ২০১৪ সালে। তখনই লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। সেই প্রক্রিয়া এখন শেষ পথে। বাড়ির লোকজন, পাড়া-পড়শিরাও মেনে নিতে শুরু করেন ‘মেয়ে অত্রি’কে। তাঁর কথায়, ‘এই যাত্রা সহজ ছিল না। হেরে যাব তাও ভাবিনি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল। মানুষের কাছে অস্বস্তির নয়, গর্বের উৎস হতে চাই।
আরো পড়ুন : ছবি ও ভিডিও সহ দেখে নিন ভারতের প্রথম সমকামী বিয়ে

গীতা ট্যান্ডন
১০ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে মেয়েকে বিদেয় করেছিল বাবা। কিন্তু সেই সংসারও সুখের হল না। বিয়ের রাত থেকেই অত্যাচার হয়ে উঠল নিত্যসঙ্গী। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন দুই সন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়েন বছর কুড়ির গীতা। মাথার উপর ছাদ নেই। খাওয়ার সংস্থান নেই। দুই সন্তানকে দু’বেলা খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে কী না করেছেন তিনি। মেসে রান্না করেছেন। ভাঙড়া দলে নেচেছেন। শেষে তো এক প্রতারকের পাল্লায় পড়ে প্রায় যৌনকর্মী হয়ে যাচ্ছিলেন। কোনও মতে বাঁচেন।

আরো পড়ুন : বিহার থেকে কোস্টারিকা, বলিউডে ঘা খেয়েও লাতিন আমেরিকায় সুপারস্টার
একদিন সুযোগ এলো তাঁর কাছে। বলিউডে ফিল্মের কাজ। তবে অভিনয় নয়। এ কাজে মূলত পুরুষদেরই দেখতে অভ্যস্থ। করতে হবে নায়িকাদের বডি ডাবলিং-এর কাজ। অর্থাত্, নায়িকাদের অ্যাকশন সিকোয়েন্সে তাঁদের ডামির কাজ। জীবনের ১৫ বছরের কঠিন লড়াইয়ের পর এখানেও সেই লড়াকু গীতা ধীরে ধীরে নজর কাড়লেন সবার। নায়িকাদের হয়ে ফিল্মের দৃশ্যে ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালিয়ে আগুনের বুক চিরে বেরিয়ে আসা, উচু থেকে লাফ দেওয়া – এককথায় তিনি ‘খতরোকে খিলাড়ি’।
বাস্তবের তিক্ত অভিজ্ঞতা, দিনের পর দিন স্বামীর অত্যাচার তাঁর মনকে লোহার মতো কঠিন করে তুলেছে। তাই এই ‘ফিল্মি ফাইট’ তাঁর কাছে নস্যি! জীবনের যে কোনও বাধাকে অনায়াসে হারিয়ে এগিয়ে চলেছেন ‘ফাইটার গীতা’। তাঁর কথায়, ‘যে পরিবেশ থেকেই উঠে আসুক প্রত্যেক নারীর সমান সুযোগ প্রাপ্য।’

ইরা সিঙ্ঘল
আরো পড়ুন : ১৫০ টাকার মজুরিতে খেটে, আজ WBCS A গ্রেড অফিসার
দিল্লীর বাসিন্দা ইরা ডাক্তারি ভাষায় ৬২ শতাংশ চলাচলে অক্ষম। তবে ৩০ বছর বয়সী এই যুবতীকে থামিয়ে রাখতে পারেনি তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। ২০১০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে চাকরি দেয়া হয়নি। কারণ, কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি শারীরিকভাবে এই চাকরির জন্য সক্ষম নন। কিন্তু প্রতিকূলতার কাছে হার মানেননি ইরা। তিনি আবারো প্রমাণ করেছেন নিজের মেধা ও যোগ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব। সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রিবিউনালের সহায়তায় তিনি যে শারীরিকভাবে সক্ষম, সেই রিপোর্ট জমা দেন। তারপর দু’বছর ইরা নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন কর্মক্ষেত্রে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে সকলে একথা মানতে বাধ্য হন যে তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম।
ইরার কথায়, ‘আমাদের সবার সমস্যা আছে। কারও ভিতরে, কারও বাইরে। সম্ভাবনা এবং নিজের ক্ষমতার ওপর জোর দিতে হবে। অক্ষমতার ওপর নয়।’