ভারত এমনিতেই মন্দিরের দেশ। পৃথিবীতে আর এমন কোন জায়গা খুঁজে পাবেন না যেখানে গেলে আপনি এতো মন্দির পাবেন। ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষ হিন্দু হওয়ার জন্য আমরা জানি এতো মন্দিরের অস্তিত্ব। নানা ধর্মের নানা বিশ্বাসের মানুষ এই দেশে ঐক্যের সঙ্গে বাস করছে বহু প্রাচীন কাল থেকেই। সভ্যতার বহু প্রাচীন কাল থেকেই ভারতের মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে দেবতারা স্থান দখল করে আছে। আর তাই আমরা সারা দেশ জুড়েই নানান আরাধ্য দেবতার মন্দির দেখতে পাই।
কথায় বলে ভারতে তেত্রিশ কোটি দেবতার বাস।আর তাই নানা দেবতার পূজা অর্চনা করার জন্য প্রাচীন কাল থেকেই রাজা মহারাজেরা নানান মন্দির স্থাপন করেছেন। আর তাদের অর্থবল ও লোকবলের সাহায্যে সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্যের অবাক করা মন্দির স্থাপন করেছিলেন। আজও তাদের বৈভব এবং প্রতিপত্তি সেই একই রকম ভাবে বিরাজ করছে।আসলে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন এবং কাঙ্খিত ফল লাভের জন্য রাজা এবং প্রজারা বহু যুগ ধরেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে আনুগত্য দেখাতে ও দেব মহিমা সকলের সামনে তুলে ধরেছেন মন্দির স্থাপনের মাধ্যমে।আর এইসব মন্দির যেন তাদের সময়কার রাজাদের শিল্পকলার ,সমাজের, অর্থনীতির এক একটি বাস্তবিক চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে।
আজও এইসব মন্দির উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হিসাবে সকলের কাছে সমান ভাবে প্রসিদ্ধ।যেমন বিভিন্ন জ্যোতিলিঙ্গ বা দ্বারকা, বৃন্দাবন বা অযোধ্যা বা কামাখ্যা তিরুপতি আরও অনেক শত শত মন্দির আছে। তবে বর্তমানে ভারতে এমন কিছু অদ্ভুত মন্দিরও আছে যা সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই।আর আজকের আলোচ্য বিষয় হল এইসব অদ্ভুত মন্দির এবং তাতে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ দেবতা নিয়ে
সোনিয়া গান্ধী মন্দির,মল্লিয়াল শহর , তেলেঙ্গানা
তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন করতে কংগ্রেস পার্টির অবদানকে মনে রাখার জন্য ,সেই নব নির্মিত রাজ্যের কংগ্রেসের জেলা নেতৃত্ব ও সমর্থকরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাপ্তন সর্বভারতীয় সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর বিগ্রহযুক্ত একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
শহীদ বাবা নিহাল সিং গুরুদ্বারা,তালহান গ্রাম, জলন্ধর
যারা বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা ও চেষ্টা করছেন তারা অবশ্যই এই গুরুদ্বারায় আসেন।এই গুরুদ্বারায় যেসব ভক্তরা আসেন ,তারা তাদের সাথে নিয়ে আসেন খেলনা উড়োজাহাজ এবং তা অর্পণ করেন এই গুরুদ্বারায়।ভক্তদের বিশ্বাস এইভাবে খেলনা উড়োজাহাজ দিলে তাদের বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা অবশ্যই পূর্ন হবে।
ভারত মাতা মন্দির,বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ অবিভক্ত ভারত থাকাকালীন ১৯৩৬ সালে দেশ মাতাকে উদ্দেশ্য করে এই মন্দিরের স্থাপনা করা হয়।এই মন্দিরে কোন বিগ্রহ নেই। তার বদলে একটা বড়ো মার্বেল পাথরের দেওয়ালের উপর অবিভক্ত ভারতবর্ষের একটি বিরাট ম্যাপ অঙ্কন করা আছে।
আরও পড়ুন : শিব পুজো যেসব দিয়ে করলে সকল মনস্কামনা পূর্ন হবে
কুকুরের উদ্দ্যেশ্যে মন্দির, চান্নাপাতনা,কর্ণাটক
কুকুরের প্রভুভক্তি এবং তাদের বিশ্বস্ততাকে সম্মান জানানোর জন্য কর্ণাটকের চান্নাপাতনা এর রামনগর জেলার স্থানীয় বাসিন্দারা এই মন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা একটি কুকুরের প্রতিমূর্তি।
অমিতাভ বচ্চন মন্দির,বালিগঞ্জ,কলকাতা
সঞ্জয় পাতোদিয়া নামের এক অমিতাভ বচ্চনের একনিষ্ঠ ফ্যান , বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনকে মানুষ হিসেবে দেখেন না, তিনি তাকে দেবতা রূপে মান্য করেন।আর তাই তাকে ভক্তি প্রদর্শনের জন্য তার নিমিত্তে একটি মন্দির স্থাপন করেন।
এই মন্দিরে পূর্বে একটি সিংহাসন ছিল যাতে অমিতাভ বচ্চন অগ্নিপথ সিনেমায় যে জুতো ব্যবহার করেছিলেন তা রাখা ছিল এবং তার সাথে অমিতাভ বচ্চনের একটি বড়ো ফ্রেম।পরবর্তীতে সারা বাংলা অমিতাভ বচ্চন ফ্যান ক্লাব থেকে এই মন্দিরে অমিতাভ বচ্চনের একটি ২৫কেজি স্ট্যাচু স্থাপন করেন।
শচীন মন্দির ,আতারবলিয়া, বিহার
মাস্টার ব্লাস্টার শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের খেলা দেখতে ভালো বাসেন না এমন ভারতীয় বা ক্রিকেটপ্রেমী সারা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না।আর ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার জন্য ক্রিকেটকে খেলা হিসাবে না দেখে এক ধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়।আর এই ধর্মের সবচেয়ে বড় আরাধ্য দেবতা হলেন লিটিল মাস্টার শচীন। আর তাই বিহারের আতারবলিয়া নাম জায়গায় শচীনের উদ্দেশ্যে একটি মন্দির স্থাপন করেন তার অনুগামীরা।এই মন্দিরে আছে তার একটি স্ট্যাচু ।এখানে টাকা দেবতা রূপে পূজা করা হয়।
ওম বান্না মন্দির,পালি ,যোধপুর ,রাজস্থান
এটি একটি মন্দির যা মোটর সাইকেলের উদ্দেশ্যে নিবেদিত করা হয়েছে।যা সাধারণত ৩৫০সিসি রয়েল এনফিল্ড বুলেট বাইকের জন্য।বাইক আরোহীরা এই মন্দিরে পূজা দিয়ে তাদের বাইক যাত্রা শুভ হওয়ার কামনা করেন।
দিগম্বশ্বরা মন্দির,নাগরালা ,কর্ণাটক
বহু প্রাচীন সময় ধরেই এই মন্দিরে এক অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত আছে।সাধারণত এই মন্দিরের বাৎসরিক এক অনুষ্ঠানে কোলের শিশুদের ৩০ ফুট উঁচু ছাদ থেকে নীচে রাখা ঝুলন্ত চাদরে ফেলে দেওয়া হয়।এইসবই নাকি কোলের শিশুর মঙ্গলের জন্য করা হয় বলেই সকলে বলে থাকেন।যদিও ২০১১ সালে এই বিপদজনক প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয় ।কিন্তু তার পরের বছর থেকেই অভিভাবক ভক্তরা তাদের কোলের শিশুদের নিয়ে আবার এই প্রথা চালু করেন।সাধারণত হিন্দু ও মুসলিম সকল ধর্মের মানুষই এই মন্দিরে আসেন।
প্রুভজয় পেরুভীরুথয় মালান্দা,কোলাম কেরালা
ভারতের মধ্যে একমাত্র এই মন্দিরেই আরাধ্য দেবতা মহাভারতের দুর্যোধন।যদিও আমরা জানি কৌরবরা তাদের লোভ ,লালসা এবং হিংসার জন্য পাণ্ডবদের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।তবুও এই মন্দিরে দেবতা হিসাবে দুর্যোধনের পূজা হওয়া সত্যিই আশ্চর্যের।
মেহেন্দিপুর বালাজি মন্দির,দৌসা জেলা, রাজস্থান
ভগবান হনুমানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই মন্দিরে প্রেতাত্মা দূর করার জন্য বিশেষ রীতি নীতি সহকারে পূজা অর্চনা করা হয়।এই মন্দির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তরা আর পিছনের দিকে তাকিয়ে যান না।অনেক ভক্তকে এখানে মাথা নিচু করে বা ঝুলন্ত অবস্থায় প্রার্থনা করতেও দেখা যায়।
ব্রহ্মা বাবা মন্দির,জৌনপুর ,উত্তরপ্রদেশ
এই মন্দিরে ভক্তরা দেওয়াল ঘড়ি অর্পণ করেন পূজার সামগ্রী হিসাবে।এই মন্দিরের দেওয়ালে অনেক ঘড়ি ঝুলে থাকতে দেখা যায়।যদিও এইসব ঘড়ি কেউ চুরি করে নিয়ে যায় না।
চীনা কালীমাতা মন্দির, ট্যাংরা,কলকাতা
এমনিতে সারা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে অনেক জায়গায় কালীমাতার পূজা করার জন্য অনেক মন্দির আছে ।কিন্তু ট্যাংরা চাইনা টাউন এর এই কালীমাতা মন্দিরে কালীমাতাচীনা উপায়ে পূজা করা হয়ে থাকে।চীনা সংস্কৃতির ধূপ ব্যবহার করা হয় এখানে।এছাড়াও প্রসাদ হিসাবে নুডলস দেওয়া হয়ে থাকে এখানে।
আরও পড়ুন : ভারতের রহস্যময় এই মন্দিরের ঝুলন্ত থাম মাটি স্পর্ষ করে না
গাতা লুপস বোতল মন্দির ,মানালি -লেহ হাইওয়ে
এই মন্দিরটি গাতা লুপসের অশরীরী আত্মার উদ্দ্যেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে।মানালি -লেহ হাইওয়েতে অবস্থিত এই মন্দিরে বাইক আরোহীরা জলের বোতল অর্পণ করে তাদের নিরাপদ যাত্রার কামনা করে।
বাবা হরভজন সিং মন্দির ,নাথুলা পাস ,সিকিম
ভারতীয় সেনা জওয়ানদের দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরটি ক্যাপ্টেন হরভজন সিং এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছিল,যিনি মাত্র ২২বছর বয়সে মারা যান। এখানে বাবার নামে অনেক কথাই লোক মুখে শোনা যায় । অনেকে বলে থাকেন বাবার আত্মা সেনাদের কোন বিদেশি শক্তির আক্রমনের খবর আগেই জানিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : ভারতের ১০টি সবচেয়ে ধনী মন্দিরের নাম ও তাদের ধন সম্পদের পরিমান
দেবজি মহারাজ মন্দির ,মধ্যপ্রদেশ
এই মন্দিরে প্রতি বছর একটি বাৎসরিক” ভূত মেলা”অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অশরীরী আত্মার ছায়ায় যেসব মানুষ পীড়িত তাদের শরীর থেকে তা দূর করার বিভিন্ন চেষ্টা করা হয়ে থাকে।এছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় এইসব ভূত পীড়িত মানুষেরা এই মন্দিরে পূজা দিয়ে তাদের শরীর থেকে ভূত তাড়ানোর আবদেন করেন।
দেবরাগাট্টু মন্দির ,কুন্নুর ,অন্ধ্রপ্রদেশ
১০০বছরের পুরানো ঐতিহ্যপূর্ণ বাৎসরিক বাণী উৎসব ,এই মন্দিরকে সবার কাছেই জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।এই উৎসবে ভক্তরা এখানে এসে লাঠি হাতে একে অপরের সঙ্গে লাঠালাঠিতে নেমে পড়েন ।আর এই লাঠালাঠি মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলতে থাকে।এই প্রথা ভগবান শিবের দ্বারা এক দৈত্যকে সংহার করার কথা মনে রাখার জন্য করা হয়ে থাকে।যদিও খবরে প্রচার পাবার পর এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা করা হয়েছিল ভক্ত মানুষের ভাবাবেগে আঘাত না করে।
আরও পড়ুন : ভারতের রহস্যময় ও অলৌকিক ৯ মন্দির
কদুঙ্গালুর ভগবতী মন্দির,ত্রিশুর, কেরালা
দেবী ভদ্রকালীর উদ্দেশ্যে নির্মিত এই মন্দিরে বাৎসরিক বারানী উৎসবে উপস্থিত ভক্তরা অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ এবং গান করতে থাকেন।এইসবই নাকি করা হয় দেবীকে খুশি করার উদ্দ্যেশ্যে।
কাল ভৈরবনাথ মন্দির, বারাণসী
ভারতের প্রাচীনতম শিব মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম এই মন্দির।এই মন্দিরে পূজার সময় ভক্তরা ভগবান শিবের উদ্দ্যেশ্যে মদ নিবেদন করে থাকেন।
চিক্কুর বালাজি মন্দির ,হায়দ্রাবাদ
এই মন্দিরের অপর নাম ভিসা মন্দির।সাধারণত যেসব মানুষ বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে বা চাকরির উদ্দ্যেশ্যে বা অন্য কিছুর জন্য বিদেশে যেতে চান, তারা এই মন্দিরে পূজা দিয়ে তাদের বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা যেন পূরণ হয় তা প্রার্থনা করেন।আর ভক্তদের বিশ্বাস এই ইচ্ছা তাদের পূর্ন হয়।তাই তারা এই মন্দিরে আসার সময় সঙ্গে করে নিজেদের পাসপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং অবশ্যই পুরোহিত দিয়ে পূজা করিয়ে নেন।
কাঁকড়া দেবী মন্দির ,কোন্দমমাই,কান্ডকুর,কর্ণাটক
প্রতি বছর নাগ পঞ্চমীর দিন এই মন্দিরে ভক্তরা শুধুমাত্র কাঁকড়া দেবীর পূজা নিবেদন করেন তা’ই শুধু নয় তারা নিজেদের শরীরে কাঁকড়া ছেড়ে দেন।তবুও তাদের শরীরে কাঁকড়া হুল ফোঁটায় না।